খাদ্যের উপাদান ও কাজ

এসএসসি(ভোকেশনাল) - এগ্রোবেসড্ ফুড -১ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | | NCTB BOOK

আমরা শরীর সুস্থ রাখার জন্য যে সকল খাদ্য গ্রহণ করে থাকি তাতে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য উপাদান থাকে । অধিকাংশ খাদ্যেই এক বা একাধিক খাদ্য উপাদান থাকে। খাদ্যে যে উপাদান বেশি পরিমাণে থাকে তাকে সে উপাদানযুক্ত খাদ্য বলা হয়। খাদ্যের উপাদানগুলোকে সাধারণত ছয়ভাগে ভাগ করা যায় যথা—

১. শ্বেতসার বা শর্করা (Carbohydrate) 

২. আমিষ (Protein) 

৩. স্নেহ বা চর্বি (Fat) 

৪. খনিজ লবণ (Minerals) 

৫. খাদ্যপ্রাণ (Vitamin ) 

৬. পানি (Water)

১. শ্বেতসার বা শর্করা : শ্বেতসার মূলত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন (C, H, O) সমন্বয়ে গঠিত এক প্রকার জৈব যৌগ যা সকল প্রকার উদ্ভিদে পাওয়া যায়। শর্করার স্বাদ মিষ্টি বা মিষ্টিহীন এবং রং সাদা। উদ্ভিদে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শর্করা উৎপন্ন হয়, যা দাহ্য হয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড, পানি ও শক্তি (ক্যালরি) উৎপন্ন হয়। শর্করা প্রধানত তিন প্রকার, যথা- মনোস্যাকারাইড, ডাই স্যাকারাইড ও পলি স্যাকারাইড। প্রায় সব ধরনের শর্করাই পানিতে দ্রবণীয় ।

সেলুলোজ (আঁশ) শর্করার একটি অপাচ্য ধরন যা ধান, গম, যব ও শাক-সবজির উপরের খোসা বা বাকলে পাওয়া যায়। এই সেলুলোজ মানুষের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।

শর্করার কাজ- 

(ক) শর্করার প্রধান কাজ হচ্ছে শরীরের তাপ ও শক্তি সরবরাহ করা। (১ গ্রাম শর্করা হতে ৪ ক্যালরি তাপশক্তি পাওয়া যায়)। 

(খ) শর্করা স্বল্প আমিষ যুক্ত খাদ্যকে (Low Protein diet) তাপ উৎপাদানের কাজ থেকে অব্যাহতি দেয় । 

(গ) কিছু শর্করা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং অস্ত্রের স্বাভাবিক সংকোচন ত্বরান্বিত করে। যেমন- সেলুলোজ ও পেকটিন। 

(ঘ) কিছু শর্করা রক্তের কোলেস্টরলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। 

(ঙ) অতিরিক্ত শর্করা শরীরে গ্রাইকোজেন হিসেবে জমা থাকে। 

(চ) দেহকে কিটোসিস নামক রোগ হতে রক্ষা করে।

শর্করার উৎস : চাল, আটা, আলু, কচু, কলা, গুড়, চিনি, মধু, কাসাভা, ভুট্টা, আম, খেজুর, নারিকেল, কাজুবাদাম, বেল, সরিষা, আতা, পেঁপে, চালতা ইত্যাদি ।

২. আমিষ : আমিষ হচ্ছে নাইট্রোজেন জাতীয় একপ্রকার জটিল জৈব উপাদান। কোষের প্রোটোপ্লাজমের প্রধান উপাদান হচ্ছে প্রোটিন। তাই প্রোটিনকে জীবকোষের প্রাণ বলা হয়। প্রোটিন খাওয়ার পর তা ভেঙে এমাইনো এসিডে পরিণত হয়। প্রোটিনে প্রায় ২০ ধরনের অ্যামাইনো এসিড থাকে। সবচেয়ে উন্নতমানের আমিষ হচ্ছে প্রাণিজ আমিষ।

আমিষের কাজ 

(ক) প্রধান এবং প্রথম কাজ হলো- দেহ গঠন, বৃদ্ধি সাধন ও ক্ষয়পূরণ। 

(খ) খাদ্যের পরিপাক ও বিপাক ক্রিয়াকে যে সকল এনজাইম প্রভাবিত করে তা প্রোটিন থেকে উৎপন্ন হয়। যেমন : পেপসিন, ট্রিপসিন ইত্যাদি । 

(গ) আমিষ জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে শরীরে এন্টিবডি ও এন্টিজেন পদার্থ তৈরি হয় যা আমিষ হতে উৎপন্ন হয়। এরা দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। 

(ঘ) রক্তের হিমোগ্লোবিন নামক আমিষ বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছ দেয়। 

(ঙ) আমিষও তাপশক্তি উৎপাদন করে (১ গ্রাম আমিষ থেকে প্রায় ৪ ক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়)। পর্যাপ্ত শর্করা ও স্নেহের অভাব হলে আমিষ ভেঙে তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয়।

(চ) আমিষের অভাবে শরীরের কোষ থেকে পানি বের হয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জমে শ্বেত রোগ (Edema) হয়।

আমিষের উৎপত্তি : মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, চিনা বাদাম, মাশরুম, শিমের বিচি ইত্যাদি।

৩. স্নেহ বা চর্বি : তেল ও চর্বি জাতীয় খাদ্যকে স্নেহ পদার্থ বলে ইংরেজিতে একে Fat বা Lipid বলা হয়। এ খাদ্য সবচেয়ে বেশি তাপ ও শক্তি সরবরাহ করে। স্নেহ জাতীয় খাদ্য ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারল দ্বারা গঠিত। কোনো কোনো উদ্ভিদ বীজে ও বাদামে স্নেহ জাতীয় খাদ্য পাওয়া যায় যেমন- জলপাইয়ের তেল, নারিকেলের তেল, সরিষার তেল, সয়াবিন ও বাদাম তেল ইত্যাদি। শরীরের জন্য প্রানিজ তেল অপেক্ষা উদ্ভিদ তেল বেশি প্রয়োজন। প্রাণিজ তেল যেমন- ঘি, মাখন, চর্বিযুক্ত মাংস ইত্যাদি খেলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ হবার সম্ভাবনা থাকে ।

স্নেহ জাতীয় পদার্থের কাজ : 

(ক) স্নেহ জাতীয় খাদ্য থেকে সবচেয়ে বেশি তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয় (১ গ্রাম স্নেহ থেকে ৯ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়)। 

(খ) স্নেহ জাতীয় খাদ্য তাপ কুপরিবাহী বলে দেহকে গরম রাখে। 

(গ) এ খাদ্যে ভিটামিন এ, ডি, ই ও কে পাওয়া যায়। 

(ঘ) উদ্ভিদ তেলের অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড ত্বক ও কোষের সুস্থতা রক্ষা করে । 

(ঙ) খাদ্যে স্নেহ জাতীয় পদার্থের ব্যবহারের ফলে সুস্বাদু ও মুখরোচক হয়।

স্নেহ জাতীয় খাদ্যের উৎস :

সয়াবিন, সরিষা, তিল সূর্যমুখী বীজ, চিনাবাদাম, নারিকেল, পাম, তুলা বীজ, ডালডা, মার্জারিন, ঘি, মাখন, চর্বি, মাছের তেল, ডিম ইত্যাদি।

৪. খনিজ লবণ : দেহের অন্যতম উপাদান হচ্ছে খনিজ লবণ। যদিও দেহে প্রায় ৯৬% জৈব পদার্থ ও বাকি ৪% অজৈব পদার্থ বা খনিজ লবণ, তবুও এই অল্প পরিমাণ খনিজ লবণ দেহের কাঠামো গঠন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। খনিজ লবণের মধ্যে যেগুলো বেশি পরিমাণে প্রয়োজন সেগুলোকে Macro minerals এবং যেগুলো কম পরিমাণে ব্যবহার হয় সেগুলোকে Trace element বলে। তবে শরীরে প্রায় ২০টি লবণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রয়োজনীয় খনিজ লবণগুলো হচ্ছে- (১) ক্যালসিয়াম (২) পটাশিয়াম (৩) সোডিয়াম (৪) লৌহ (৫) ম্যাগনেসিয়াম (৬) ম্যাঙ্গানিজ (৭) দস্তা (৮) তামা (৯) লিথিয়াম (১০) ফসফরাস (১১) গন্ধক (১২) ক্লোরিন (১৩) বেরিয়াম (১৪) আয়োডিন (১৫) সিলিকন (১৬) ফ্লোরিন ইত্যাদি। এর মধ্যে ১০টি দ্বারা শরীরের ক্ষারীয় এবং ৬টি দ্বারা শরীরের অম্লভাব বজায় থাকে।

ক্ষার জাতীয় লবণ : ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, দস্তা, তামা, লিথিয়াম ও বেরিয়াম।

অম্ল জাতীয় লবণ : ফসফরাস, গন্ধক, ক্লোরিন, আয়োডিন, সিলিকন ও ফ্লোরিন।

খনিজ লবণের কাজ

১) ক্যালসিয়াম 

ক) ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস হাড় ও দাঁত গঠন করে এবং মজবুত করে। 

খ) প্রতিটি জীবকোষ গঠনে এর প্রয়োজন। 

গ) এটি রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় উপাদান ।

লৌহ : 

(ক) রক্তের লাল অংশ ও হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে। 

(খ) হিমোগ্লোবিন ফুসফুস থেকে বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে। 

(গ) কিছু এনজাইম বা জারক রস গঠনে লৌহের প্রয়োজন।

লৌহ জাতীয় খাদ্যের উৎস : কচুশাক, লালশাক, আলু, পুদিনা পাতা, শশা, শালগম, করলা, মূলা, ডাল, পেঁয়াজ, তরমুজ, মটরশুঁটি, খেজুর, যকৃৎ, মাংস, ডিম, গুড়, তেঁতুল, চিংড়ি, শুঁটকি মাছ ইত্যাদি।

আয়োডিন :

(ক) আরোভিন শরীরের থাইরক্সিন নামক হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে। 

(খ) থাইরক্সিন দৈহিক ও মানসিক বিকাশ সরাসরি প্রভাবিত করে। 

(গ) গর্ভবতী মায়ের জন্য আয়োডিন খুবই প্রয়োজন, অন্যথায় প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিতে পারে।

আয়োডিন জাতীয় খাদ্যের উৎস : বিভিন্ন শাকসবজি, সামুদ্রিক মাছ (তাজা ও শুঁটকি), শামুক, ছাগলের দুধ, শেওলা, মাছের তেল ইত্যাদি।

ভিটামিন : শর্করা, আমিষ স্নেহ পদার্থ ছাড়াও কিছু কিছু জৈব উপাদান সুস্থতা ও বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয়। এগুলোকে খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন বলে। বেরিবেরি ও স্কার্ভি রোগকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন আবিষ্কার হয়েছে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা যেমন- অসবার্ন, মেন্ডেল, ম্যাককলাম ও ডেভিস প্রমাণ করেন যে, লেবুতে স্কার্ভি প্রতিরোধক ভিটামিন- সি, মাখন ও চর্বিতে ভিটামিন-এ, দুধ, গম ও চালের কুঁড়ায় ভিটামিন বি পাওয়া যায়। খাদ্যে ভিটামিন খুবই অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয়। দ্রবণীয়তার ভিত্তিতে ভিটামিন দুই প্রকার। যেমন (১) চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন : ভিটামিন এ, ডি, ই ও কে (২) পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন : ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন সি ।

Content added By
Promotion